বড়দার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের প্রতি এতো dedication যে তিনি পরিবার সম্বন্ধে উদাসীন ছিলেন। গান,  নাচ, শিক্ষাদান, রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে শিক্ষা ও আদর্শ পাওয়া – বড়দা ঐ নিয়েই থাকতেন। কাজের লোকেরা এসে বলছে ‘এটা নেই ‘ – উনি বলতেন ‘চালিয়ে নে’। আমার মা তখন বলতেন দাঁড়া আমি ব্যবস্থা ক’রে দিচ্ছি। ওদের ভাইদের মধ্যে অভাবনীয় সাত্তিকতা ছিল। অরা যদি শুনতেন অন্যরা কেউ ওঁদের নামে নিন্দা করেছেন, বলতেন ‘ছেড়ে দাও। ঠিক আছে’। শুনেছি আনন্দময়ী মা বড়দাকে ডেকে দীক্ষা দিয়েছিলেন, উনি তখন বেনারসে। বাড়ি এসে আমার মা কে বলেছিলেন, “জানো মামীমা, আমার মধ্যে কী আছে কে জানে, – উনি নিজেই আমাকে ডাকলেন, দেখা করলেন”।   

আমি শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করার সময় বড়দা ছিলেন সঙ্গীতভবনের অধ্যক্ষ। তখন মাধবদা ছিলেন, নায়ারজী ছিলেন। নাচের ক্লাসে যেতাম। বড়দা বাবাকে বললেন, ও তো পাশ করেছে, এবার ওকে তুমি নাচে দাও। আমার কিন্তু তখন আঁকার প্রতি প্রবল আগ্রহ, আমি বললাম , “না বাবা, আমি কলাভবনে ভর্তি হব”। বড়দা একটু মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন। কলাভবনেই ভর্তি হলাম। তখন  মাস্টারমশাই নন্দলাল বসু সবে অবসরগ্রহণ করেছেন। কিঙ্করদা, বিনোদদা, যমুনাদি , গৌরীদি রাধাচরণ বাগচী – এঁরা সব ছিলেন। 

এবার চিত্রভানুর কথা বলি। গুরুদেব একবার গৌরীপুরে গিয়ে এই জমিটা দেখেন, এবং এখানে ওঁর বাড়ি করার খুব ইচ্ছে হয়। শান্তিনিকেতনের স্থাপত্যের আদলে। গুরুদেব তো পাহাড় খুব ভালোবাসতেন , ওঁর খুব ইচ্ছে ছিল কালিম্পং এ মাঝে মাঝে এসে থাকার। বৌঠান তখন তাঁর সঙ্গে ছিলেন। জায়গাটা একটা টিলার ওপর, সেখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার বেল্ট টা পুরো দেখা যায়।  এমন একটা জায়গা বেছেছেন , যেখানে দৃষ্টিটা আটকে যাবে না। জমিটা কেনা হয় কিন্তু বাড়ি তৈরীর আগেই গুরুদেব মারা যান ১৯৪১ এ।  ১৯৪৩ তে রথীন্দ্রনাথ সেই জমিতে বাড়িটা তৈরি করেন ও তার নাম দেন চিত্রভানু। রথীন্দ্রনাথ মাঝে মাঝে সেখানে আসতেন , ওঁর জন্যে একটা ঘর রাখা ছিল।

রথীন্দ্রনাথ যখন মারা গেলেন তখন বৌঠান চিন্তায় পড়লেন কালিম্পঙের বাড়িটা নিয়ে কী করবেন। অমিয় সেন আর ডি এম সেন কে নিয়ে পরামর্শ করেন। পাহাড়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতের কোনো চল ছিল না, রবীন্দ্রসঙ্গীতের সংস্কৃতি কিছুই ছিল না । অথচ পাহাড়ী মেয়েদের মধ্যে  সঙ্গীত ও নৃত্যের প্রচুর প্রতিভা । প্রতিমাদেবী ও রথীন্দ্রনাথ দীর্ঘ সময় কালিম্পং এ কাটিয়েছেন ও দেখেছেন যে পাহাড়ে মেয়েদের কোনো আর্থিক উপার্জনের ব্যবস্থা নেই, এদিকে এরা প্রচুর পরিশ্রমী । বৌঠানের ইচ্ছে হল  এই মেয়েদের জন্যে কিছু করার। এরা বড়ই গরীব। এদিকে ঠিক সেই সময়েই ডঃ বিধান চন্দ্র রায় পার্বত্য এলাকার ডেভেলপমেন্ট নিয়ে চিন্তাভাবনা করছিলেন।  ভারত সরকারের পক্ষ থেকে একটা Team পাঠানো হ’ল Social education – মানে গ্রাম উন্নয়নের শিক্ষার জন্যে। ওটা ছ’ মাসের course ছিল, basic training এর। ঐ Team এ আমরাও যুক্ত হলাম।  ওটা হচ্ছে Women’s Arts and Crafts Training Centre. বৌঠান ডঃ বিধান রায়ের কাছে প্রস্তাব পাঠালেন। অমিয়দা তখন পাঠভবন ছেড়ে সরকারের Social Education Department এ চলে গেছেন, D M Sen Education Secretary. সরকার বাড়িটি অধিগ্রহণ করেন ১৯৬৪ তে বোধহয় – ফার্নিচার সমেত পুরো বাড়িটাই সরকারকে দিয়ে দেওয়া হ’ল। তখন বাড়িটার ভগ্নদশা – সেই বাড়ির মধ্যেই Social Works Department চালু হ’ল। Music আর Horticulture compulsory  ছিল। ওঁরা শান্তিনিকেতন থেকে কলাভবনের ছাত্রী চাইলেন Art Teacher হিসেবে । আমি প্রথমে একজন teacher হিসেবে যোগ দিলাম। পরে ইনচার্জ হয়েছি।

বড়দার কালিম্পং ছিল sentimental জায়গা। এক তো রথীবাবু প্রতিমা বৌঠানের বাড়ি- তাছাড়া ভাই অমল রঞ্জনের ছেলে বাচ্চু সেখানে মারা যায়। বাচ্চু ওখানে কলেজে পড়াত। বড়দা চিত্রভানুতে এলেন ১৯৭৬ এ , যখন তাঁর বয়েস ৭৬। তখন তো গাড়ি ছিল না, উনি বাসেই এলেন , সঙ্গে খুকুমনি। হস্টেল  ওয়ার্ডেন কৃষ্ণা আর খুকুমনি ওঁর সঙ্গে থাকত আর ওঁর খাওয়া দাওয়া দেখাশোনা করত , কারণ আমি তখন খুব ব্যস্ত। প্রতিমাদেবীর ঘরটাতেই বড়দার থাকার ব্যবস্থা হ’ল। বসার ঘরে বসে বড়দা বললেন  , জানো মনে হচ্ছে জাহাজে বসে আছি’।  চিত্রভানুতে অনেকেই আসতেন বড়দার সঙ্গে দেখা করতে। একদিন আমি বললাম , বড়দা, এখানকার কয়েকজন নেপালী মেয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখতে খুব উৎসাহী – আমার কাছে দু বছর ট্রেনিং নিয়েছে। ওরা সঙ্গীত ভবনে ভর্তি হতে চায়। তোমার কাছে আসবে। ওরা interview দেবে ’।  বড়দা শুনে খুব খুশী হলেন। বললেন, ‘ওদের বোলো আসতে ।ওদের টীচার ও সঙ্গীতভাবনের ছাত্রী – সেও এল।  ৪/৫ জন ছাত্রী এল। বড়দা নিজেই তাদের তানপুরা বেঁধে দিয়ে বললেন, ‘এবার তোমরা গাও। তোমরা নিজের ভাষাতেই গাও।‘ ওরা গাইল, প্রত্যেকে selected হ’ল। 

তখন কিন্তু সুধীরঞ্জন দাস কালিম্পঙে । আমার সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। প্রতি রোববার আমি ওঁর বাড়িতে যেতাম। এক রবিবার সুধীদাকে বললাম বড়দা এসেছেন। তখন উনি বললেন ,’বোলো আমার কাছে আসতে। একবার দেখা করতে বোলো। বড়দা তো শুনে রেগে একাকার। ‘অসম্ভব! আমি যাবনা।‘  বড়দা সুধীদার সঙ্গে দেখা করতে যান নি । কিন্তু আমাকে তো সুধীদা কে উত্তরে কিছু বলতে হবে – আমি বললাম , ‘সুধীদা, বড়দার শরীরটা ভালো নেই, তাই আসতে পারলেন না’। উনি বুঝলেন। শুধু বললেন, “ আচ্ছা”। মেয়েরা selected  হবার পর যখন সুধীদাকে গিয়ে বললাম বড়দা ওদের interview নিয়েছেন এবং সবাই পাশ করেছে, উনি কিন্তু খুব খুশি হলেন। আমার অনুরোধে সুধীদা তখনকার বিশ্বভারতী উপাচার্য সুরজিত সিনহা কে চিঠি লিখে দিলেন এই মেয়েদের সঙ্গীতভবনে নিয়ে নেবার জন্য। এরা  সবাই সঙ্গীতভবনে ভর্তি হয়েছিল এবং শিক্ষা সমাপ্ত করেছিল। এদের মধ্যে একজন নেপালে গিয়ে গাইয়ে হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।

সেই একবার ই বড়দা চিত্রভানুতে এসেছিলেন।  কালিম্পং এ থাকার সময় যখন ফুরিয়ে এল তখন একদিন বড়দা সবার জন্যে কিছু কিনে নিয়ে যেতে চাইলেন। বড়দা কে নিয়ে গেলাম ‘ Beauty Palace’ নামে এক পাঞ্জাবিদের দোকানে । সবার জন্যে কিছু না কিছু কিনলেন, ঝুমার জন্যে একটা খুব সুন্দর হার কিনলেন। বললেন, “ও তো নাচে, ওর জন্যে এটা নিয়ে যাই”। যেখানেই বেড়াতে যেতেন পরিবারের মেয়েদের জন্যে কিছু নিয়ে আসতেন। 

Share: