পরমশ্রদ্ধেয় শৈলজাদার কথা লিখতে গিয়ে আমার ছোটোবেলার শান্তিনিকেতনের কথা মনে পড়ছে। কবে ইশকুলে ভরতি হলাম, কেমন করে শৈলজাদার সঙ্গে পরিচয় হল— সে-সব কথা এখন আর তেমন স্পষ্ট করে মনে পড়ে না।
এখন যেখানে চীন ভবন, তারই পাশে টিনের চাল দেওয়া একটি বাড়ি ছিল। সেই বাড়ির মাঝের ঘরটিতে রোজই সন্ধ্যায় দেখতাম শিক্ষকদের মধ্যে কেউ একজন বসে গান শেখাতেন। সেটা গানের ক্লাস না গানের কোনো মহড়া সে কথাও ঠিক মনে নেই। ছোটোবেলা থেকেই গান শুনতে এবং গাইতে ভালো লাগত। তাই পাঠভবনে ভরতি হবার আগেই দিদির সঙ্গে রোজই সেই গানের জায়গায় গিয়ে বসতাম। এজন্য কারো কাছ থেকে কোনো বাধা কোনোদিন পাইনি।
আমাদের সৌভাগ্যবশত শান্তিনিকেতনে আমরা যে-সব শিক্ষকদের কাছে গান শিখবার সুযোগ পেয়েছিলাম, রবীন্দ্রসংগীতের এক-একটি দিক তাঁরা আমাদের মনে স্পষ্ট করে মুদ্রিত করে দিয়েছিলেন। সেইজন্য তাঁদের সকলের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই ৷
শৈলজাদার হাতেই আমার নিজের রবীন্দ্রসংগীতে প্রথম হাতেখড়ি। পাঠভবনে ভরতি হবার পর ওঁর কাছে আমাদের গানের ক্লাস পড়ল। যতদূর মনে পড়ে ‘দূর দেশী সেই রাখাল ছেলে’ গানটি আমাকে প্রথম আলাদা করে শিখিয়ে পাঠভবনের সাহিত্যসভায় গাইয়েছিলেন। আস্তে আস্তে ওঁর বিশেষ নজরে পড়েছি বুঝতে পারিনি। তবে মনে পড়ে ক্লাসে একটা গান শেখা হয়ে গেলে সেটিকে একা একা গাইয়ে যতক্ষণ না তৈরি হত তিনি ছাড়তেন না। সুরের সূক্ষ্মতার দিকে তিনি প্রথম থেকেই বিশেষ নজর দিতেন। যতক্ষণ আমরা সেটিকে নিখুঁতভাবে আয়ত্ত করতে না পারতাম ততক্ষণ উনি স্বস্তি পেতেন না৷ এসরাজের এক-একটি সুরের ঘাটের সঙ্গে গলাকে মিলিয়ে স্বরস্থানগুলি স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিতেন।
বর্ষামঙ্গল, বসন্ত-উৎসব বা কোনো নৃত্যনাট্য বা গীতিনাট্যের গান আমাদের যখন শেখাতেন, কী অক্লান্ত পরিশ্রম করতে ওঁকে দেখেছি। এখন শিক্ষকতা করতে গিয়ে ওঁর ধৈর্য এবং অক্লান্ত পরিশ্রমের কথা বারে বারে মনে পড়ে। ভেঙে পড়ার মুখে তাঁর আদর্শ নিত্যই প্রেরণা জোগায়।
উনি সারাজীবন গুরুদেবের গানের সাধনায় কাটিয়েছেন। রবীন্দ্রসংগীতকে উনি প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছেন। কিন্তু ওঁর মধ্যে আরেকটি দিক বিশেষ করে আমার নজরে পড়েছে। যারা গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের গানকে ভালোবেসেছে, তাদেরও তিনি ভালোবেসেছেন। আমাদের সঙ্গেই এমন অনেকে ছিল যাদের হয়তো গান শিখবার ক্ষমতা খুব একটা ছিল না, কিন্তু আগ্রহ ছিল একান্ত। শৈলজাদা গান শেখাতে যেমন ভালোবাসতেন তাদেরও তেমনি ভালোবাসতেন। তাদেরও টেনে নিতেন গানের মহড়ায়। অনুষ্ঠানের দিনে তারা মঞ্চে বসার সুযোগ না পেলেও গান শিখতে পেরে এবং কিছুদিন সকলের সঙ্গে বসে গান করতে পেরে তারা নিজেদের ধন্য মনে করত এবং শৈলজাদাও তৃপ্ত হতেন। আশ্রমের অনেক গৃহিণী যাঁদের গানের গলা ছিল কিন্তু বিশ্বভারতীর কোনো ক্লাসে বসার সুযোগ ছিল না, তাঁদের নিয়ে শৈলজাদা একটা গানের ক্লাস শুরু করেছিলেন। তাঁরা এ সুযোগ পেয়ে খুবই খুশি হয়েছিলেন। আমরা ওঁদের সঙ্গে একসঙ্গে বসে কত গান গেয়েছি এবং শিখেছি, সে কথা মনে হলে খুব আনন্দ হয়।
এখনকার মতন সেসময়ে বৈতালিক করবার দায়িত্ব ভবনে ভবনে ভাগ করে দেওয়া ছিল না। একটা সময়ে বেশ দীর্ঘদিন আমরা গুরুপল্লীর কয়েকজন মেয়ে মিলে সকালের বৈতালিকে গান গাইতাম । প্রতিদিনের বৈতালিকের গান শৈলজাদা যত্ন করে শিখিয়ে দিতেন। সেই সুযোগে আমরা অনেক নতুন গানও শিখেছিলাম। মন্দিরের জন্য হঠাৎ কোনো গানের প্রয়োজন হয়েছে, রাত্রে বাড়ি গিয়ে বসে শিখিয়ে দিয়েছেন। যতক্ষণ না পরদিন গাইবার মতন তৈরি হয়েছে ছাড়েননি। ৭ই পৌষ রাত্রের বৈতালিক সেরে আবার ভোরবেলা বাড়িতে গিয়ে ডেকে এনেছেন ভোরের বৈতালিকের জন্য। এর অন্যথা দেখেছি বলে মনে পড়ে না ।
শান্তিনিকেতনের বাইরেও যখন থেকেছেন, গান ছাড়া থাকতে পারেননি। গান শিখবার দল জুটে গিয়েছে। তাদের নিয়েই একটা ছোটোখাটো অনুষ্ঠান করে ফেলেছেন।
ওঁর শিক্ষাদানের মধ্যে একটি দিক আমায় বিশেষ আকর্ষণ করেছিল। গানের কোন কথাটিতে কোমল সুর লেগেছে, কোন জায়গাটিতে কেন একটি স্বরের বিশেষ ব্যবহার হয়েছে, তার সুন্দর বিশ্লেষণ ওঁর কাছে পেয়েছি। গান শেখাতে গিয়ে বলেছেন, কথা দিয়ে সুরটিকে মনে রাখতে। সুরের সঙ্গে কথার যে মিল ওই বয়সে তিনিই আমাদের প্রথম দেখতে শিখিয়েছিলেন।
পড়াশোনার প্রতি ওঁর অগাধ শ্রদ্ধা দেখেছি বরাবর। পাঠভবনে পড়তে পড়তে হঠাৎ যখন সংগীতভবনে ভরতি হয়েছিলাম, উনি খুশি হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু পড়াশোনা যাতে না ছেড়ে দিই সেই দিকে আমার অভিভাবকের মতনই কড়া নজর রেখেছিলেন। এখন মনে হয় যে ওঁর একান্ত আগ্রহ বা উৎসাহ না পেলে হয়তো আমার জীবন অন্য পথে চলে যেত।
নিজের মেয়ে থাকলে তার সর্বাঙ্গীণ মঙ্গলের প্রতি যেমন নজর রাখতেন আমার প্রতিও তেমনি রেখেছেন। এ কথা হয়তো একান্ত ব্যক্তিগত নয়, তাঁর ছাত্রছাত্রীরা সকলেই তাঁর কাছ থেকে পিতৃস্নেহ লাভ করেছেন।
আজ দীর্ঘদিন ধরে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে গাইতে যে দৃষ্টি দিয়ে জীবনকে দেখতে শিখেছি, সেই দৃষ্টি আমার সমস্ত জীবনকে যদি সুন্দর ও সার্থক করে থাকে তবে এই সার্থকতার মূলে রয়েছে শৈলজাদার অশেষ স্নেহ ও যত্ন। তাই শৈলজাদার কথা লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে যে ওঁর সম্বন্ধে যা বলতে চেয়েছিলাম সে কথা না বলাই রয়ে গেল।
তবু কোনোদিন যদি রবীন্দ্রসংগীত গাইতে গাইতে কথা ও সুরের উপলব্ধি আমার মনকে উদ্ভাসিত করেছে, সেদিন মনে হয়েছে আমার প্রণাম গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের পায়ে পৌঁচেছে। তবে সঙ্গে সঙ্গে আমার আর-একটি প্রণামও পৌঁচেছে আমার রবীন্দ্রসংগীতের শিক্ষাগুরু পিতৃকল্প শৈলজাদার পায়ে।
১৯৭৪ সালে ‘সুরঙ্গমা’ (প্রাক্তনী)-প্রকাশিত ‘রবীন্দ্রসংগীতাচার্য শ্রীশৈলজারঞ্জন মজুমদার’ সংবর্ধনা পুস্তিকার অন্তর্গত।