শৈলজারঞ্জন মজুমদারের সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জী
শৈলজারঞ্জনের জন্ম হয় নেত্রকোনার বাহাম গ্রামে, রমনীকিশোর ও সরলা সুন্দরীর পরিবারে
বাহামের পার্শ্ববর্তী পাইকুরা গ্রামে গোঁসাইজির পাঠশালায় পড়াশুনা শুরু হয়
- নেত্রকোনা দত্ত হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন
- জামতাড়া স্কুলে বোর্ডিং এ ভর্তি হন। সেখানে তাঁর কাকাদের কাছ থেকে প্রথম জানতে পারেন শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমের কথা।
চারুকাকার কাছ থেকে রবীন্দ্রসংগীতের স্বরলিপি পাঠ ও হারমোনিয়াম বাজানোর শিক্ষা, গীতমালিকার গান তোলেন হারমোনিয়াম এ
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে বর্ষামঙ্গল অনুষ্ঠানে প্রথম রবীন্দ্রনাথের আবৃত্তি ও স্বকন্ঠে গান শোনেন
মা সরলা সুন্দরীর দেহাবসান। রামমোহন লাইব্রেরী হলে বর্ষামঙ্গল দেখতে গিয়ে -রবীন্দ্রনাথকে কাছ থেকে দেখেন ও প্রণাম করেন
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন নিয়ে এম এস সি তে রসায়ন শাস্ত্রে ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হন। রসায়নশাস্ত্রে গবেষণা ও একই সংগে আশুতোষ কলেজে অধ্যাপনা শুরু হয়
সৌম্যেন ঠাকুরের ‘পাগলা ঝোরা’ পালায় কোরাস গানে যোগদান। সেখানে রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রথম তিনটি গান শেখা ।
ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী র বাড়িতে প্রসিদ্ধ যন্ত্রবিদ শীতল মুখোপাধ্যায়ের কাছে এস্রাজের তালিম নেন
ওকালতি পড়েন পিতার আজ্ঞায়। ল’ স্কুলে প্রভাত চন্দ্র গুপ্তের সঙ্গে আলাপ হয়।
বন্ধু প্রভাত চন্দ্র গুপ্তর আমন্ত্রনে শান্তিনিকেতনে আসেন, এক সপ্তাহে দিনেন্দ্রনাথের কাছে ১৪ টি গান শেখেন। উঠেছিলেন শান্তিনিকেতন বাড়ির গেস্ট হাউস এ।
দিনেন্দ্রনাথের কাছ থেকে শেখা গান দিয়ে নেত্রকোণায় দত্ত হাই স্কুলে রবীন্দ্র জন্মোৎসব পালন করেন
শান্তিনিকেতনে কেমিস্ট্রি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ‘নতুন বাড়ি’তে থাকার ব্যবস্থা হয়।
মঙ্গলবারের সন্ধ্যের সভায় প্রথম একক গান ‘ গগনে গগনে আপনার মনে’ । ‘কালের যাত্রা’ নাটকে অভিনয়ে অংশগ্রহণ।
‘বৈকুন্ঠের খাতা’ নাটকে বিপিনের ভূমিকায় অভিনয় দিনেন্দ্রনাথ ও স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে।
- হেমেন্দ্রলাল রায়ের কাছে হিন্দুস্থানি ক্লাসিক্যাল গান শেখা, বচ্চন মিশ্রর কাছে সারেঙ্গীর তালিম নেওয়া চালু । রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে একটি সারেঙ্গী উপহার পান।
- লখনৌ এ প্রতিমাদেবীর সঙ্গে গানের দল নিয়ে গেলেন শাপমোচন আর নবীন পরিবেশন করতে। সেই বছরই দিনেন্দ্রনাথের সঙ্গে গেলেন বম্বে, শাপমোচন আর তাসের দেশ এর দল নিয়ে।
- সংগীতভবন কলাভবন থেকে পৃথক হয়ে নিজস্ব সত্তায় প্রতিষ্ঠিত হয় কিন্তু নিজস্ব গৃহ না থাকায় অস্থায়ী অবস্থাতেই শিক্ষা চর্চা চলে।
- শৈলজারঞ্জনের প্রথম স্বরলিপি ‘মম মন উপবনে’ প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকার কার্তিক সংখ্যায়। সেই বছরেই তাঁর করা শাপমোচন এর দুটি গানের স্বরলিপিও প্রকাশিত হয় দিনেন্দ্রনাথের অনুমোদনে ।
- জুন মাসে গুরুদেবের সঙ্গে উইলমোট পেরেরার ব্যবস্থাপনায় যান সিংহলে ( অধুনা শ্রীলঙ্কা) ওঁর কথায় গুরুদেব ম্যাড্রাস এ ওঁর আত্মীয়র বাড়ি হয়ে ট্রেন এ হাওড়া ফেরত আসেন।
দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতন ত্যাগ করে চলে যান। এরপর শৈলজারঞ্জনের রবীন্দ্রনাথের কাছে নিয়মিত একলা বসে গান শেখা শুরু। প্রথম শেখা গান মায়ার খেলার ‘পথহারা তুমি পথিক যেন গো’। হারমোনিয়াম এর ব্যবহার বর্জন করেন শৈলজারঞ্জন। রবীন্দ্রনাথ স্বরলিপি তৈরির ভার দেন শৈলজারঞ্জনকে।
গুরুদেবের নির্দেশে ছোটোদের গান শেখাতে শুরু করেন। ‘রবীন্দ্র-পরিচয় সভা’র ‘গীতোৎসব-শরৎপর্ব’ আয়োজন করেন – প্রথম নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী অনুষ্ঠান।
ত্রিপুরার মহারাজা সংগীত ভবন নির্মাণের জন্যে কুড়ি হাজার টাকা দান করেন। নতুন ভবন নির্মিত হয় । দ্বিতীয়, তৃতীয় খন্ড স্বরবিতান প্রস্তুত হয় শৈলজারঞ্জনের তত্ত্বাবধানে। প্রতিমা দেবী কিছুকাল সংগীতভবনের দায়িত্ব নেন ।
- রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছাক্রমে রথীন্দ্রনাথের নির্দেশে শৈলজারঞ্জন রসায়ন অধ্যাপক এর পদ বজায় রেখে সংগীতভবনের প্রথম অধ্যক্ষ পদ গ্রহণ করেন। সেই বছর বর্ষামঙ্গলের জন্যে শৈলজারঞ্জন ষোলোটি নতুন গান রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে আদায় করে নিলেন। ‘ডাকঘর’ নাটকের জন্যে নতুন গান রচিত হল , তার মধ্যে ‘সমুখে শান্তি পারাবার’ গানটি রবীন্দ্রনাথ শৈলজারঞ্জনকে বলেন কাউকে না শেখাতে যতদিন না তাঁর মৃত্যু হয়।
- সেই সময় সংগীত ভবনে অধ্যাপনা করেন শান্তিদেব ঘোষ, সমরেশ চৌধুরি , সুধীর কর, অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুশীল কুমার ভঞ্জ, ভি ভি ওয়াজেলয়ার, কে কে ওয়ালিওর, অটম্বা সিং, উমাপদ ধর, শ্যামাপদ কর্মকার প্রমুখ
রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিকালে শেষবার বর্ষামঙ্গল হয় শৈলজারঞ্জনের তত্ত্বাবধানে
- কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের দেহত্যাগ। শান্তিনিকেতন উপাসনা মন্দিরে শৈলজারঞ্জন ‘সমুখে শান্তি পারাবার’ গানটি করান রবীন্দ্রনাথের পূর্ব নির্দেশ অনুসারে।
- এই বছরেই গীতবিতান সঙ্গীত সংস্থা প্রতিষ্ঠা হয় যেখানে পরবর্তীকালে শৈলজারঞ্জন External Examiner হন।
ইন্দিরা দেবী স্থায়ীভাবে শান্তিনিকেতনে বসবাস শুরু করেন ও বিশ্বভারতীর প্রনেত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। শৈলজারঞ্জনকে সংগীত ভবনের কার্যক্রম, পরীক্ষা নীতি তৈরী করার কাজে সাহায্য করেন। কালমৃগয়া ও ভানুসিংহের পদাবলী তে আরো গান যোগ ক’রে নাট্যরূপ দেন ইন্দিরা দেবী । ( স্মৃতিসম্পুট তৃতীয় খন্ড –ইন্দিরা দেবী)
সংগীত ভবনের অধ্যাপক রূপে যোগদান করেন শৈলজারঞ্জনের ছাত্র সুবিনয় রায় ও ছাত্রী কণিকা মুখোপাধ্যায় ।
শৈলজারঞ্জনের অনুমতিক্রমে শ্রীমতী মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায় আনন্দ পাঠশালায় নিয়মিত গান শেখাতে শুরু করেন।
যুবরাজ করণ সিং এর আমন্ত্রণে কাশ্মীরে শান্তিনিকেতনের দল নিয়ে যান। ‘চিত্রাঙ্গদা’ ও ‘ভানুসিংহের পদাবলী’ নৃত্যনাট্য পরিবেশন। লুধিয়ানায় ‘চিত্রাঙ্গদা’ পরিবেশনা । রেঙ্গুন এ রবীন্দ্রজয়ন্তী ও বর্ষামঙ্গল।
রেঙ্গুন এ ব্রহ্ম সরকারের উপদেষ্টা ডঃ নীহাররঞ্জন রায়ের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথের কর্মধারার আলোচনা ও চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্য পরিচালনা করেন ।
রেঙ্গুন এ শ্যামা র দল নিয়ে যান ।
ব্রহ্মদেশের প্রধানমন্ত্রী উ নুর বাসভবনে ভানুসিংহের পদাবলী পরিবেশন – কিছু নতুন গান যুক্ত ক’রে । কলকাতায় সুরঙ্গমা রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষায়তন এর প্রতিষ্ঠার পর তার দায়িত্ব গ্রহণ করেন ।
শৈলজারঞ্জন সঙ্গীতভবনের অধ্যক্ষপদ থেকে পদত্যাগ করেন কিন্তু উপাচার্য সত্যেন বোস তাঁকে পুনর্নিয়োগ করেন
বিশ্বভারতী কতৃপক্ষর সঙ্গে মতানৈক্য হওয়ায় পদত্যাগ করেন ও শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে যান।
ইন্দিরা দেবীর মৃত্যু।
রবীন্দ্রশতবর্ষ পালিত হয় শান্তিনিকেতন ও কলকাতায়। সেই সূত্রে অনুষ্ঠান করেন আশ্রমিক সঙ্ঘে ও নানা জায়গায়। তাঁর অনুরোধে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আকাশবানী তে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনে বিশেষভাবে শুদ্ধতা রক্ষার নির্দেশ দেন ।
কলকাতায় স্থায়ীভাবে থাকার পরিকল্পনা। কসবা তে ভাড়া বাড়িতে কিছুদিন থাকা
করুনাকেতন এর উদ্যোগে খ্রীস্টোফার রোডের ভাড়াবাড়িতে কনিষ্ঠ ভ্রাতা দেবজ্যোতি ও ভ্রাতৃবধূ নমিতার তত্ত্বাবধানে বাস করতে শুরু করেন
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় শৈলজারঞ্জনকে ডি লিট উপাধি প্রদান করে। ‘সুরঙ্গমা’ তাঁকে সম্বর্ধনা দেয়।
সুরেশ সঙ্গীত সংসদ তাঁকে ‘মিউজিশিয়ান অফ বেঙ্গল’ নির্বাচন করে সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী সূচিত স্বর্ণপদক দেন। ঢাকায় বসন্তোৎসব আয়োজন , ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষাদান করেন। শিলাইদহ কুঠিবাড়ি , সাজাদপুর কাছারিবাড়ি, কুষ্টিয়া লালন ফকিরের আশ্রম , রাজশাহী প্রভৃতি জায়গায় ভ্রমণ করেন।
কনভেন্ট রোডে তাঁর ভাই প্রবোধ রঞ্জনের বাড়িতে থাকতে শুরু করেন, সেখানে ক্লাসও নিতেন।
শীতকালে কানপুরে ভাগ্নে বলেন্দ্রনাথের বাড়িতে কয়েক মাস ছিলেন।
- বিশ্বভারতী সঙ্গীতভবনে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষাদান করেন প্রচুর ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের।
- শৈলজারঞ্জনের প্রচেষ্টায় মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর উদ্যোগে কলকাতায় রবীন্দ্রসদনে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষকদের সম্মেলন হয় শুদ্ধভাবে শিক্ষা দেবার পদ্ধতি আলোচনা করার জন্যে। ভারতের ও বাংলাদেশের অনেক শিক্ষক উপস্থিত হয়েছিলেন।
- গরমের ছুটিতে কিছুদিন দুর্গাপুরে ভাগ্নে জ্যোতিরিন্দ্র র বাড়িতে কাটান।
সল্ট লেক বাসভবনে ভাই অমল রঞ্জন ও ভ্রাতৃবধূ কমলার তত্ত্বাবধানে বাস করতে শুরু করেন। এখানেই জীবনের শেষ কয়েকটি বছর অতিবাহিত করেন।
৭ ই পৌষ তাঁকে শান্তিনিকেতন আশ্রমিক সঙ্ঘ শ্রদ্ধার্ঘ প্রদান করে এবং তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী ‘অগ্নিরক্ষা’ বই প্রকাশ করে।
বিশ্বভারতী কর্তৃক ‘দেশিকোত্তম’ উপাধিতে ভূষিত হন
পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ বিদ্যাপীঠে ‘ডঃ দুর্গাপদ ঘোষ স্মৃতি পুরস্কার’ প্রচলন করেন। দ্বিতীয়বার বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন বুলবুল একাডেমি অফ ফাইন আর্টস, রামকৃষ্ণ মিশন ও সঞ্জিদা খাতুন এর ছায়ানট গোষ্ঠীর ব্যবস্থাপনায় ও বেগম সুফিয়া কামাল এর নেতৃত্বে। ঢাকায় Indian High Commission তাঁকে সম্বর্ধনা দেন। ময়মনসিংহ টাউন হল তাঁকে বিরাট সম্বর্ধনা দেয় এবং চট্টগ্রামের গুণীজনেরা তাঁকে Guard of Honour জানান। নেত্রকোনা ও বাহাম গ্রামে জন্মস্থান দর্শন করেন।
কলকাতায় শিশির মঞ্চে অমলেন্দু সাঁই এর পরিচালনায় শৈলজারঞ্জনের জন্মদিন পালিত হয়, সেখানে – মায়া সেন, অরবিন্দ বিশ্বাস, নিলীমা সেন, প্রসাদ সেন , অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
শৈলজারঞ্জন মজুমদারের পরিচালনায় প্রস্তুত ‘বিবেকানন্দের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত’ শীর্ষক একটি ক্যাসেট কলকাতার গোলপার্কে অবস্থিত রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচারে প্রকাশিত হয়।
২৪ মে কলকাতার সল্ট লেক বাসভবনে ৯২ বছর বয়সে প্রয়াত হন। তাঁর শেষযাত্রায় বহু শিল্পী , ছাত্রছাত্রী সামিল হন।